Friday, April 1, 2016

সাবলিমেশন প্রিন্টিং: স্বল্প পুঁজিতে চমৎকার আয়ের মাধ্যম





















আজকে আপনাদের নতুন একটি বিজনেস আইডিয়া শেয়ার করছি,
যারা অলরেডি প্রিন্টিং ব্যবসায় আছেন, বা নতুন করে শুরু করতে চাচ্ছেন, অথাব গিফট আইটেমের ব্যবসা আছে তারাও এটি করতে পারেন।
আমরা বার্থডে, ম্যারেজডে, ভ্যালেন্টাইনসডে, বিয়ে সহ নানা অনুষ্ঠানে গিফট দেই কাছের মানুষদের। কিন্তু সে গিফট টি যদি গতানুগতিক ধারার না হয়ে একটু আনকমন হয় তবে সেটা যাকে দিবেন তার খুশির মাত্রাটা অনেক বেড়ে যাবে।

হা আজকে সেটা নিয়েই কথা বলব।
সে ব্যবসাটা করতে আপনার সর্বোচ্চ পুজিঁ লাগবে ১ লাখ টাকার মত।
যা করতে পারবেন
**
মগে বা প্লেটে কাষ্টমাইজ পিকচার বা টেক্সট প্রিন্ট
**
গেঞ্জিতে মনের মত ডিজাইন সহ ছবি প্রিন্ট
**
মেরেজডেতে অর্নামেন্টে দুজনের ছবি
**
ভ্যালেন্টাইনস ডে তে মগ, কুশন, রুমাল, এ দুজনের একান্ত ছবি
**
ছোট্ট বাবুর বার্থডেতে সবাইতো খেলনা গাড়ি দেয় আপনি দিলেন তার ছবিওয়ালা পুতুল সেট, বা এংরিবার্ডস ডল সাথে তার ছবি
**
ফটো গ্লাস বা স্টোনে ছবি সহ সুন্দর কোন লেখা

এছাড়া আরো হাজারো মনের মত গীফট নিজেই কাষ্টমাইজড করে নিতে পারেন।
কিভাবে শুরু করবেন
এটা টোটালি Sublimation প্রিন্টিং টেকনোলজিতেই করা হয়
এর জন্য কিছু মেশিনারী একটি প্রিন্টার, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ লাগবে
শুধু মগের জন্য মাত্র ১২০০০ +- এর একটি হিট প্রেস মেশিন
একটি কালার প্রিন্টার
কম্পিউটার
কিছু পেপার আর এক্সেসরিজ
ব্যাস এতটুকুই ,
শুধু মগের উপর করতে চাইলে কিছু ব্লাংক মগ সহ মাত্র ৫০০০০ টাকার মধ্যেই শুরু করে দিতে পারেন।
কিছু মেশিনারী আপনার চাহিদা অনুযায়ী নিতে পারেন

এ মেশিনটি হলো থ্রি-ডি সাবলিমিশন হিট মেশিন। সাবলিমিশন জগতে এটি একেবারেই লেটেষ্ট সংস্করণ । প্রশ্ন করতে পারেন কি করা যায় এটি দিয়ে। আমার পাল্টা প্রশ্ন কি করা যায়না এটি দিয়ে?
ভিডিওটি দেখেন তাহলেই বুঝবেন কি কি করা যায়।
এটি হলো এনালগ মগ প্রেস মেশিন। দাম খুব বেশিনা। কিন্তু এটা দিয়েই মাসে লাখ টাকা কামানো যাবে।
লটে যখন অনেক কাজ পাবেন তখন এটা ব্যবহার করতে হবে । দাম খুব বেশিনা।
যারা টি-শার্টে হিট প্রিন্টিং কাজ করতে চান এটি তাদের জন্য

কোন শোভাযাত্র বা অনুষ্ঠানে কাষ্টমাইজড ক্যপ প্রিন্টিং এর জন্য এ মেশিনটি
মেশিনগুলা তো দেখলেন। সিম্পল কিছু মেশিন এখন দেখেন কি কি কাজে ব্যবহার করা যাবে?
কিসে করা যায় সেটা বলতে তো সারাদিন লিখতে হবে তার চেয়ে একটা প্রোডাক্ট স্যাম্পল ক্যাটালগ দিচিছি সেটা দেখে নেন

মোটকথা কাষ্টমাইজড যে কোন কিছুতেই সাবলিমিশন প্রিন্ট করা যায়
সিরামিক  মগ, কালার চেঞ্জ মগ
চাবির রিং, ক্যপ, টি শার্ট
মাউস, মাউস প্যাড, অর্নামেন্ট,
সহ হাজারো আইটেম

Friday, March 4, 2016

মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার তত্ত্ব ও স্বরূপ

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : ইসলাম আগমনের পূর্বে খৃস্টধর্মের সর্বত্র বিস্তার ঘটেছিল। রোমান সম্রাট প্রথম কনস্টান্টাইন কর্তৃক খৃস্টধর্ম হিসেবে গৃহীত হয়। রোমান সাম্রাজ্যের অধীন সমগ্র ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বৃহদংশ শাসিত হত। খৃস্টযুগের পূর্বে মিসর, বেবিলন, এশিরীয়, চীন, ভারত, গ্রিস প্রভৃতি পৃথক পৃথক রাজনৈতিক রাষ্ট্রে উদ্ভব ঘটেছিল। সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে বিশ্ব সভ্যতায় তাদের ফলপ্রসূ অবদান ছিল এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু গ্রিসের পতনের পর বিশ্ব ইতিহাসে কোথাও আমরা জ্ঞানবিজ্ঞান বিকাশে প্রসার ঘটতে দেখিনি। চীন এবং ভারতে জ্ঞানবিজ্ঞানের কিছু কিছু শাখায় যেমনÑ নীতিবিদ্যা (Ethics) জ্যোতির্বিদ্যা (Astronomy)এবং ঔষধিশাস্ত্রে (Medicines) কিছুটা অগ্রগতি হলেও কুসংস্কার এবং অবাস্তব বিশ্বাসের ফলে এসব ক্ষেত্রেও অগ্রগতি ব্যাহত হয়। শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে রোমানদেরও তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না। কলুষিত রাজনীতি চর্চার কারণে তাদের সমাজে জ্ঞানবিজ্ঞানের সার্বিক বিস্তার ঘটেনি।
প্রাচীন মিসরে জ্ঞানবিজ্ঞানের যে অগ্রগতি ঘটেছিল তা সর্বজনবিদিত। তারা জন্ম দিয়েছিল চমক লাগান একটি সভ্যতার। তাদের পুরাকীর্তি, স্মৃতিচিহ্ন ও জীবনকর্ম মানুষ এখনও সংরক্ষণ করছে। এরপর খুব শিগগিরই প্রাচীন গ্রিকরা জ্ঞানবিজ্ঞানে মিসর এবং অন্য সকল দেশকে ছাড়িয়ে যায়। তারা সমসাময়িক সভ্যতার আদর্শ শুধু নয়, বর্তমান বিশ্বসভ্যতায় ও পাশ্চাত্যে তাদের অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তাধারা মানবজাতির জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই গ্রিক দর্শনের যে কোনও আলোচনায় সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল ছিল সর্বজন প্রশংসিত। তবে গ্রিক দর্শনের সমস্ত আলোচিত মতবাদের উৎপত্তি হয়েছিল ভ্রমাত্মক (Fallacious) তথ্যের ভিত্তিতে। ‘ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, মানবসভ্যতার ইতিহাস, বাংলাবাজার, ২০০১ পৃ: ৪০৪।’ গ্রিকধর্ম যুক্তিবাদ ও জড়বাদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত ছিল, যা তাদের দর্শনে কোনও ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। যে সমস্ত গ্রিকবাসী শিক্ষাকে পছন্দ করত না তারা তাদের জাতীয় মনীষীদেরও সম্মান করত না। দীর্ঘ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে গ্রিক (হেলেনিক) সভ্যতার ঐতিহ্য মিটমিট করে জ্বলছিল, যা পরবর্তীতে রোমানদের কিছুটা আলো দেখালেও খৃস্টধর্মের উত্থানের সময় (৩২০ খৃস্টাব্দ) তা সম্পূর্ণ নিভে গিয়েছিল। এছাড়া প্রবল শ্রেণি বৈষম্যের কারণে গ্রিক সভ্যতার সমৃদ্ধির যুগেও (খৃ: পূ: ১২০০ অব্দ-৮০০ অব্দ) শিক্ষাদীক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল কেবল শাসকশ্রেণির অনুগত আমলা ও ধর্ম যাজকদের জন্য উন্মুক্ত। বিশাল জনগোষ্ঠীর অন্যান্য শ্রেণির জন্য শিক্ষাগ্রহণ করা ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ÔProf. Hamiuddin Khan, History of Muslim Education, Vol-1 Karachi, 1967, P-10Õ. আর সাধারণ জনগণ অন্ধ অশ্লীলতায় ও কুসংস্কার নিমজ্জিত ছিল। তাই সাধারণ ধ্যান-ধারণায় মনে হলেও প্রকৃত অর্থে এ যুগে জ্ঞানবিজ্ঞান বিকাশে তেমন কোনও অগ্রগতি হয়নি। গ্রিকদের অসাধারণ ব্যুৎপত্তি জ্ঞান, ধীশক্তির দ্বারা বীরগাথা (Ballads), লোকসঙ্গীত (Folksongs), পৌরাণিক কাহিনী (Short epic), অংকশাস্ত্র (Mathematics),, প্রাণিবিদ্যা (Zoology) ও চিকিৎসাবিজ্ঞান (Medical Science)--এর কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় তেমন কোনও অগ্রগতি এ সময় আমাদের চোখে পড়ে না। তাই যেটুকু জ্ঞানবিজ্ঞান ও সভ্যতা টিকেছিল পরবর্তীকালে তা ইউরোপকে আলো দেখাতে পারেনি। এছাড়া খৃস্টধর্মের আবির্ভাব যুগের পর থেকে ধর্মগুরুরা শত সহস্র বছর শিক্ষার আলো থেকে দেশের উঠতি জনসাধারণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ইতিহাসের বেদনাদায়ক অধ্যায় হলো ইউরোপীয় রেনেসাঁ অবদি এই দীর্ঘসময় তারা অমানবিক আচরণ করেছে নিরপরাধ মানুষের প্রতি তাদের ধর্ম ও প্রভুর নামে। তারা মানবীয় বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তার স্বাধীনতাকে তোয়াক্কা করেনি এবং যে সমস্ত শিক্ষিত লোক প্রাচীন গ্রিকগ্রন্থ পাঠ করত তারা নির্যাতিত ও কখনো কখনো রাজদ্রোহী বলে গণ্য হতেন। গ্রিকদের প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রাচীন পাঠাগার এ সময় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
পৃথিবীকে গোলাকার বলা ছিল অপরাধ। ঠিক সেই অজ্ঞানতার জন্যই হিপাসিয়ার দেহকে তার জ্ঞান পিপাসার জন্য আলেকজান্দ্রিয়ার গির্জায় খ-বিখ- করা হয়েছিল। গ্যালিলিওকে রোমের পবিত্র গির্জায় আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল। কোনও লোকই নিজের সম্পদ, জীবন বা দেহের নিরাপত্তা রক্ষা করে প্রচলিত মতবাদের প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে পারতো না। ফলে কোথাও কোনও আইনপ্রণেতা দার্শনিক ও কবির আবির্ভাব ঘটেনি। ÔJ.W. Draper, Intellctual Development in Eurpoe, New Yourk, 1966 P-9. এভাবে মধ্যযুগে জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
অন্যদিকে প্রাক-ইসলামী যুগে আরবে কবিতা, বক্তৃতা, উপদেশাবলী, প্রবাদ, উপাখ্যান ও অন্যান্য গদ্য রচনার নিদর্শন পাওয়া গেলেও তাদের এ সাহিত্যরস গোত্রীয় বীরদের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, যুগের বিবরণ, উটের বিস্ময়কর গুণাবলী, বংশ গৌরব, অতিথিপরায়ণতা, নর-নারীর প্রেম, নারীর সৌন্দর্য, যুদ্ধবিগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে তাদের ভাষা খুব সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু উক্ত যুগে আরব সমাজে ভাষাভিত্তিক উন্নতির পরিচয় মিললেও শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কোনও অগ্রগতি সাধিত হয়নি।
হযরত মুহাম্মদ (সা:) (৫৭০-৬৩২ খৃ:) প্রথম তাঁর অনুসারীদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য ব্যাপক উৎসাহ দান করেন। এর ফলেই তার অনুসারীরা শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিতে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। আল-কুরআনের প্রথম বাণী- ‘পড়, তোমার প্রভুর নামে’ অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘যাকে বিজ্ঞানের জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাকে উত্তম সম্পদ দেয়া হয়েছে।’ মহানবী বলেছেন, ‘জ্ঞানের অন্বেষণে যে তার বাসস্থান ত্যাগ করে, সে আল্লাহর পথে ভ্রমণ করে,’ ‘সকল মুসলিম নর-নারীর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ,’ ‘শহীদের রক্তের চেয়ে বিদ্যানের কালি পবিত্রতর,’ ‘যে শিক্ষাগ্রহণ করে তার মৃত্যু নেই।’
এসব উক্তি ছাড়াও শিক্ষাগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর কুরআন, হাদীসের বহু উক্তি রয়েছে। এভাবে ইসলামে শিক্ষার জন্য উৎসাহ দান করা হয়েছে। কিন্তু মহানবী (সা:) তাঁর জীবদ্দশায় শিক্ষাকে বিভিন্ন স্তরে সন্নিবেশিত করেননি। কারণ ধর্মের দৃঢ়ীকরণে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার সাধনে তাঁকে সর্বত্র ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। তবে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা কি হওয়া উচিত সে বিষয়ে তিনি সুচিন্তিত মতামত ঠিকই দিয়েছিলেন।
মুসলিম সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল আরবে। ইসলাম আরবদের মধ্যে যে উন্নত মানসিক চেতনার সৃষ্টি করে মূলত তা ছিল ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের ফল। আর ইসলামের গোড়ার কথা ছিল শিক্ষা। ইসলামে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো প্রতিপালককে জানার মাধ্যমে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। ইসলামের দৃষ্টিতে যে নিজেকে চিনেছে সে তার প্রভুকে চিনেছে। নিজেকে উপলব্ধি করে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয় ইসলামে শিক্ষার উদ্দেশ্য।
মহানবী (সা:) মসজিদকে শিক্ষার কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। যা পরবর্তীকালে মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। খোলাফায়ে রাশেদুনের সময়ে মুসলমানদের খেয়াল ছিল সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করা তবে উমাইয়া এবং পরবর্তী আব্বাসীয় আমলে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় স্বর্ণযুগে পৌঁছে। উল্লেখ্য, মুসলিমসমাজে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছাত্রদের সুপ্ত কর্মদক্ষতাকে জাগিয়ে তোলা। যাতে তাদের অন্তর্নিহিত বুদ্ধি শৃঙ্খলা প্রাপ্ত হয় এবং নৈতিক ও বৈষয়িক দিক দিয়ে প্রস্তুতিগ্রহণে সক্ষম হয়। এ উদ্দেশ্যে ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিমসমাজে মসজিদ থেকে শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়া হতো। মহানবী (সা:) মসজিদে বসে সাহাবাদের কুরআন শিক্ষা এবং জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও পরামর্শ দিতেন। তাঁর সময় মদীনাতেই নয়টি মসজিদ ছিল। এগুলো শিক্ষাদানের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল। মদীনা ও এর আশেপাশের মুসলমানরা এ সকল মসজিদে শিক্ষাগ্রহণ করতো। হযরত (সা:) মাঝে মাঝে নিজেই মসজিদের এই সকল শিক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শন করতেন।
মক্কা শিক্ষায়তনে সাধারণ মানুষের শিক্ষার দায়িত্ব মুয়াজ ইবন জাবালের ওপর অর্পিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস তার স্থলাভিষিক্ত হন। এছাড়া আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান ও আব্দুল্লাহ ইবনে-আল-যুবায়ের অন্যতম শিক্ষক ছিলেন। কাবা প্রাঙ্গণে হাদীস, ধর্মতত্ত্ব, আইনশাস্ত্র ও সাহিত্য পড়ানো হতো।
তবে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে মক্কার চেয়ে মদীনা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিতরণের জন্য সাহাবাদের অধিকাংশই এখানে বাস করতেন। যায়েদ ইবনে-সাবিত ও আব্দুল্লাহ-ইবনে-ওমর শিক্ষার প্রতি অনুরাগের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। সা’দ-ইবনে-আল-মুসাইব, উরওয়া-ইবনে-আল যুবাইর ইবনে-আল-আউয়াম, ইবনে শিহাব আল-যাহরি-আল-কোরাইশী ও মালিক ইবনে-আনাসের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ মদীনার ছাত্র ছিলেন।
সিরিয়া বিজয়ের পর ইসলামের প্রাথমিক দিনগুলোতে মুয়াদ, উবায়দা ও আবুল দারাদাহ সিরিয়াবাসীদের কুরআন ও ফিকহশাস্ত্র শিক্ষা দেয়ার জন্যই হযরত ওমর (রা:) কর্তৃক নিয়োজিত হয়েছিলেন। হযরত ওমর (রা:) ইসলামী শিক্ষার ওপর বক্তৃতা দেয়ার জন্য কুফা, বসরা ও দামেস্কের মসজিদে কতিপয় বিদ্বান লোককে নিযুক্ত করেছিলেন। প্রতি শুক্রবার তাদের বক্তৃতা শ্রবণ করার জন্য জনসাধারণ মসজিদে সমবেত হতো। এ ধরনের বক্তৃতাকে ‘মুযেযা’ বলা হতো। এই বক্তৃতার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে মসজিদগুলো শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র পরিণত হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে মসজিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে ঐতিহাসিক খোদা বখস বলেছেন, ‘খৃস্টানদের গির্জা যেমন ধর্মীয় শিক্ষাদান করে মুসলমানদের মসজিদ তেমন নয়। মসজিদ শুধু ধর্মীয় উপাসনারই স্থান নয়, এটা জ্ঞানবিজ্ঞানেরও কেন্দ্র। মুসলমানগণ এসে সম্মান দেখিয়ে থাকে সত্য; কিন্তু কোনও প্রকার প্রশংসনীয় কাজের জন্য মসজিদকে ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করে না।’ ÔKhuda Bukhsh, Contributions to the History of Islamic Civilization. Vol.II, Calcutta, 1930, P-268.
উল্লেখ্য, দেশের সর্বস্তরের মানুষের নিকট শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়া ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় কর্তব্য। আর ধর্মকে সবার ওপরে স্থান দেয়ায় ধর্মবিস্তারে, যুদ্ধ পরিচালনায় এবং প্রশাসনিক ব্যাপারে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে হতো। বিশ্বনবীর বাণী (হাদীস) ও কুরআনকে বোঝার জন্য সবার মনে প্রবল আগ্রহ জন্মে। তাই যে কোনও প্রকারে সযতেœ মুসলিম শিক্ষারমান রক্ষা করা হতো। সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে উমাইয়া যুগ অবধি শিক্ষার্থীদের প্রধান প্রধান পঠিত বিষয় ছিল তাফসির, হাদীস, আরবী ভাষা, কবিতা, গণিত Uyun al-Akbar and Bayan Wat Tabyin by Jahiz ed, Sanduli, Vol-II, P-134’ ইত্যাদি।
উমাইয়া খলিফারা সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করা এবং বিজিত অঞ্চলে তাদের শাসনকে সুদৃঢ় ও জাতীয়করণের দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা আরবী ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করেন। সিরিয়ায় সিরীয় ও গ্রিক, মিসরে কপটিক, পারস্য ও মেসোপটেমিয়ায় আরামাইকের পরিবর্তে আরবী ভাষা প্রচলিত হয়। এরূপ প্রাথমিক অবস্থায় উমাইয়াদের পক্ষে কোনও নতুন শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন ও পরিচালনা করা সহজ ছিল না। তবে এ সমস্ত অসুবিধা সত্ত্বেও উমাইয়া আমলে হাদীস, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ছাড়াও ইতিহাস, ভূগোল ও জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়ন শুরু হয়। এ সময়ে অবাধ বক্তৃতা ছিল শিক্ষাদানের বিশেষ পদ্ধতি। এ পদ্ধতি উমাইয়া আমলের শেষপর্যন্ত চলছিল। ÔMohd. Abdul Muid Khan, The Muslim Theories of Education During the Middle ages, The Journal of Islamic Culture, Oct. 1944, P-420.’. একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা শ্রবণ করার জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থী শ্রোতা উপস্থিত হতো। পারিশ্রমিকের কোনও প্রত্যাশা না করে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বেচ্ছাকৃত কাজ হিসেবেই সাহাবা, কুরাইশ ও আরবের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। পরবর্তীকালে শিক্ষাদান কার্যক্রম বেতনভোগী পেশায় পরিণত হয়। উমাইয়া শাসন দমননীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকায় কিছু কবি ও গল্পকথককে তাদের প্রচারণা ও প্রশান্তির জন্য বেতনভোগী পেশায় নিয়োজিত করা হয়েছিল। এছাড়া উমাইয়া রাজপুত্রদের জন্য সিরিয়া মরুভূমিতে স্বতন্ত্র পর্যায়ের বিদ্যানিকেতন গড়ে ওঠে। লেখাপড়ার পাশাপাশি যুদ্ধ কৌশলও এখানে শেখানো হত।
তবে উমাইয়া শাসকদের শিক্ষাবিস্তারে উদার মনোভাবেরও পরিচয় পাওয়া যায়। উমাইয়া দরবারে গুণীজনকে সম্মান ও পৃষ্ঠপোষকতা করা হত। খালিদ-ইবনে-ইয়াজিদ-ইবনে-মারিয়াও উন্নত সাহিত্যরুচি ও দার্শনিক চিন্তাধারার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি একজন কবি, বক্তা ও সাহিত্যরসিক ছিলেন। তিনিই প্রথম জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা ও রসায়নশাস্ত্রের ওপর গ্রিক গ্রন্থ আরবীতে অনুবাদের ব্যবস্থা করেন। উমাইয়া যুগের অন্যতম চিকিৎসাবিদ হারিস ইবনে কালাদার ‘আরববাসীদের ডাক্তার উপাধি লাভ করেছিলেন। কথিত আছে ওমর ইবনে আব্দুল আযীয আলেকজান্দ্রিয়া হতে এন্টিয়ক ও ইরাকে মেডিকেল স্কুল স্থানান্তরিত করেছিলেন। তার আমলে বহু গ্রিক গ্রন্থ আরবীতে অনূদিত হয়েছিল। কাজেই দেখা যায়, শিক্ষাদীক্ষায় ও জ্ঞানবিজ্ঞানে উমাইয়া যুগ একেবারে পিছিয়ে ছিল না। এছাড়া এই বংশের আব্দুর রহমান আব্বাসীয়দের নিকট হতে আত্মরক্ষা করে স্পেনে উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারই চেষ্টায় স্পেন মধ্যযুগে প্রাচ্য ও পাশ্চত্যের অন্যমত শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। মূলত আব্বাসীয় যুগে যে শিক্ষা সংস্কৃতির পূর্ব বিকাশ ঘটে তার প্রস্তুতি যুগ হিসেবে উমাইয়া যুগকেই ধরা হয়।
আব্বাসীয় যুগকে মুসলিম জ্ঞানবিজ্ঞান ও সভ্যতার স্বর্ণযুগ বলা হয়। যদিও মদীনায় মহানবী (সা:) কর্তৃক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভ হতে ইসলামী সমাজে সর্বদাই শিক্ষার আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত ছিল। কিন্তু উমাইয়া আমল পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিকতাই ছিল এর বৈশিষ্ট্য। উমাইয়া যুগে যে শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা হয় আব্বাসীয় যুগে তা বিরাট মহীরূহে পরিণত হয়। বস্তুত উমাইয়া যুগে বসরা কুফার যেখানে শেষ; আব্বাসী আমলে সেখান হতে তার যাত্রা হয় শুরু। ÔP.K. Hitti, History of the Arabs, London, 1951 P-245. উমাইয়াদের মতো আব্বাসীয় রাজ পরিবারের শিশু সন্তানদের মরুভূমির গৃহশিক্ষকের কুত্তাব-এ প্রেরণ করার প্রয়োজন শেষ হয় এবং এ সময় বাস্তব বা পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে আসে আমূল পরিবর্তন। আব্বাসীয় আমলে যখন সর্বজন স্বীকৃত নীতিস্কুল (হানাফী, শাফী, মালেকী, হাম্বলী) প্রতিষ্ঠিত হয় তখন মৌখিক শিক্ষা পদ্ধতির বদলে লিখিত বিষয়ে শিক্ষা প্রাধান্য লাভ করে। Mohd, Abul Muid Khan, OP, Cit, P-421.
আব্বাসীয় যুগে মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থায় দুটি স্তর ছিল। প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান ভিত্তি ছিল মসজিদ কেন্দ্রিক মক্তব বা কুত্তাব। মসজিদ এবং তার সংলগ্ন স্থান এমনকি নির্দিষ্ট স্থানে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হতো। অনেক শিক্ষাব্রতীদের গৃহেও প্রাথমিক শিক্ষালাভের ব্যবস্থা ছিল। এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অনেক সময় ‘মজলিসুল আদব’ বলে আখ্যা দেয়া হতো। শিক্ষকদের বলা হতো মুয়াদ্দির, মুয়াল্লিম বা মুকাতির। মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের এ সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরবী ভাষা, কুরআন পাঠ, ইসলামী শ্রুতি বা স্মৃতিশাস্ত্র, দৈনন্দিন ধর্মীয় ব্যবহারিক বিষয় মৌখিক পাঠদান করা হত। একই সঙ্গে আরবী হস্তলিপি, হিসাববিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ ও কবিতা শেখান হত। প্রাথমিক স্কুলের ভাল ছাত্রদের পুরস্কৃত করা হত। মেয়েদের প্রাথমিক পর্যায়ে পাঠগ্রহণে উৎসাহিত করা হত। ''Hitti, OP, Cil. P-408'''. রাজ পরিবার ও অভিজাত ঘরের শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য নিয়োগ করা হত নানা দেশের মুয়াদ্দিব। তারা রাজপ্রসাদে শিশুদের ধর্মশিক্ষা, সাহিত্য এবং কাব্যশিল্প শিক্ষাদান করতেন। আমিনের শিক্ষককে তাঁর পিতা খলিফা হারুনুর রশীদ যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা থেকে তৎকালীন শিক্ষার আদর্শ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। হারুন উক্ত শিক্ষককে বলেছিলেন যে, তিনি ছাত্রের প্রতি যেন শক্ত না হন যাতে তার সহজাত বৃত্তিগুলো বিকৃত হয়; আবার তিনি এত নম্র হবেন না যে, সে সুযোগে ছাত্ররা অলস হয়ে পড়বেন। তিনি প্রথমে দয়া ও সহানুভূতি দেখিয়ে ছাত্রকে সোজা করার প্রয়াস চালাবেন, তবে তাঁর নমনীয় আচরণ যদি ব্যর্থ হয় তবে তাঁকে ছাত্রের প্রতি কঠোর হতে হবে। “ইবনে খালদুন, মুকাদ্দিমা-মুসা আনসারী কর্তৃক ‘মধ্যযুগের মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রন্থ উদ্ভুত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা-১৯৯৯, পৃ: ৩২৮”। খলিফা তার যুবরাজের সুশিক্ষার প্রয়োজনে শিক্ষককে বেত ব্যবহারেরও অনুমোদন দিয়েছিলেন। ইবনে সিনা তাঁর ‘রিসালাতুল সিয়াসতে’ শিক্ষককে ছড়ি ব্যবহারের উল্লেখ করেন। ''Hitti, OP, Cit, P-409'' প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মুখস্থ করার ওপর বেশী জোর দেয়া হত।
উচ্চ শ্রেণির শিক্ষা- ছাত্রদের মেধার ভিত্তিতে বিভিন্ন রকমের হতো। এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের ইচ্ছাও কাজ করত। কিছু ছাত্র ছিল যারা শিক্ষার নির্দিষ্ট শাখায় শিক্ষিত হয়ে অন্যান্য শিক্ষার্থীদেরও ঐ শাখায় জ্ঞানী করে তুলতে অনুপ্রাণিত হত। একশ্রেণির ছাত্র ছিল যারা তাদের শিক্ষা সীমাবদ্ধ রেখেছিল ব্যক্তিগত অর্জনের মধ্যে, মানবকল্যাণ তাদের লক্ষ্য ছিল না। আর একশ্রেণির ছাত্র ছিল যারা নিজেদের সমাজে ভালো সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার জন্য যোগ্য করে তুলত। আর একশ্রেণির ছাত্র ছিল যারা চিত্রকর্ম, বিজ্ঞান, অথবা হস্তলিখন বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে নির্দিষ্ট পেশায় কাজ করত। ‘Mohd, Abdul Muid Khan, OP, Cit, P-420’.
মধ্যযুগের মুসলিম শাসনামলে বাগদাদ, বসরা, কুফা, কর্ডোভা, কায়রো প্রভৃতি স্থান উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। শিক্ষকদের মধ্যে তিন শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন। প্রথম শ্রেণির যে সমস্ত শিক্ষক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের কুরআন শিক্ষা দিতেন তাদের মুয়াল্লিম বলা হতো। ধর্মতত্ত্ব সংক্রান্ত জ্ঞানের জন্য কখনো কখনো তাদের ফকীহ বলা হতো। মুয়াল্লিমদের সামাজিক মর্যাদা ছিল সামান্য। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষকদের ‘মুয়াদ্দিব’ বলা হতো। তারা মর্যাদাসম্পন্ন লোকের ও খলীফাদের সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা দিতেন। এই শ্রেণির শিক্ষকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে উচ্চ স্তরে ছিলেন। এর পরের স্তরে ছিলেন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত অধ্যাপকবৃন্দ। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জনসাধারণ খুব শ্রদ্ধা করত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকা ভাগ থাকলেও উচ্চ স্তরের শিক্ষার জন্য পাঠ্যতালিকা অনুসরণের কোনও ধরাবাধা নিয়ম ছিল না। প্রত্যেক শিক্ষক বা অধ্যাপকের নিজস্ব শিক্ষাপদ্ধতি এবং পাঠ্যতালিকা ছিল। অধ্যাপক নিয়োগ এবং বরখাস্ত করার অধিকার বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছিল। কিন্তু শিক্ষাপদ্ধতি ও পাঠ্যক্রম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষকরা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতেন। ধর্ম বিপদাপন্ন হলেই শুধু সরকার হস্তক্ষেপ করত। ‘Khuda Bukhst, OP. Cit, P-421’. অধ্যাপকরা তাদের বক্তৃতায় সাধারণত স্বরচিত অথবা অন্য কোনও লেখকের বই অনুসরণ করতেন। অভিজ্ঞ শিক্ষকদের পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ ছিল। ফলে বক্তৃতা দেয়ার সময় তাদের কোনও অসুবিধা হতো না। শিক্ষকরা বক্তৃতা দিয়েই সন্তুষ্ট হতেন না, তিনি চেস্টা করতেন যাতে ছাত্ররা তার বক্তৃতা বুঝতে পারেন। এই জন্য তিনি ছাত্রদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন এবং ছাত্রদেরও প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বলতেন। অনেক শিক্ষকই কোনও বিষয়ের ওপর আলোচনাকালে নিজের আসন ছেড়ে ছাত্রদের সঙ্গে মিশতেন। ‘Khuda Bukhs, OP, Cit, P-283. অনেক সময় শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরেও ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ করতেন। শিক্ষকরা কোনও কোনও সময় ছাত্রদের লেখাপড়ার সমস্যায় তাদের গৃহে আসতে বলতেন। ছাত্ররা শিক্ষকদের অত্যন্ত সম্মান ও যথার্থ সেবা করতেন। মধ্যযুগের মুসলিম জনপদে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করে। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের বেতন অনেকটা নিয়মিত হয়ে উঠেছিল। ইবনে বতুতা তার বর্ণনায় শিক্ষকদের পারিশ্রমিক দৈনিক পনের দিনারের কথা বলেছেন। এছাড়া শিক্ষক ও দরিদ্র ছাত্ররা মসজিদ, পবিত্র স্থান, হাসপাতালের আয়, ধনী সম্প্রদায়ের চাঁদা হতে সাহায্য লাভ করতেন। সরকারি কোষাগার হতেও তাদের বেতনভাতা দেয়া হত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত ছুটির ব্যবস্থা ছিল না। পাঠ্যবিষয় অধ্যয়ন শেষ না হলে ছুটি হতো না। কোনও নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি আয়ত্বে আনার পরেই কিছুদিন অবকাশ দেয়া হতো।
শিক্ষাক্ষেত্রে মধ্যযুগে খানকাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এ সময় থেকে মুসলিম বিশ্বের নানা স্থানে খানকা গড়ে ওঠে। সুফীরা তাদের খানকায় শিষ্যদের দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিতেন। কালক্রমে খানকাকে ঘিরে মাদরাসা ও পাঠাগার গড়ে ওঠে। ইরাক ও ইরান ভ্রমণকালে ইবনে বতুতা অসংখ্য খানকা দেখেছেন। এছাড়া বয়স্কদের শিক্ষিত করা ও নিরক্ষরতা দূর করার জন্য প্রচেষ্টা চালান হতো। অ্যনেক স্থানে নিয়মিতভাবে শিক্ষাদানের জন্য পরিষদ ছিল।
আব্বাসীয় সোনালি যুগে ধর্মজ্ঞান বিকাশে আর একটি বড় অবদান হলো মুসলিম ব্যবহার শাস্ত্রের উন্মেষ। আব্বাসীয় আমলে পরিবর্তিত বাস্তব অবস্থায় মুসলিম সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন ধর্মীয়, সামাজিক, আর্থ রাজনৈতিক সমস্যাবলীর সমাধানের প্রচ- তাগিদে তাদের ধর্মজ্ঞানের আর একটি নতুন স্বতন্ত্র কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা, আইনবিদ্যার উদ্ভব হয়। ‘মূসা আনসারী, মধ্যযুগের মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা-১৯৯৯, পৃ: ৩৪৩।’ কুরআনের ঐশী বাণীতে আল্লাহর অনুজ্ঞাসমূহ বিধৃত হয়; সুন্নায় তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়; কিন্তু সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ, বিস্তৃত ও সুসংহত রূপ লাভ করে এবং তার অন্তর্নিহিত যৌক্তিক সূত্রায়ন ঘটে ইলমূল ফিকহ বা ব্যবহারিক শাস্ত্রে। ঐতিহাসিক বিচারে এ শাস্ত্রের বিকাশ গুরুত্ব বহন করে। আব্বাসীয় যুগের বাস্তবতায় ব্যবহারিক শাস্ত্রের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও সুসংহত রূপদানের প্রয়োজন হয়। আইন অধ্যয়নের জন্য কয়েকটি কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এরূপ আইন স্কুলের নিজস্ব ধ্যান-ধারণায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে। আবু হানিফা নোমান বিন সাবিত (৬৯৯-৭৬৮ খৃ:) ছিলেন ইরাকী স্কুলের প্রাণপুরুষ। ইরাকী স্কুলকে ঘিরে হানাফী মাজহাব গড়ে ওঠে। হেজাজি স্কুল বা মালেকী মজহাবের প্রাণপুরুষ ছিলেন মালেক বিন আনাস (৭১৪-৭৯৫ খৃ:)। আব্বাসীয় শাসনের প্রারম্ভে যুক্তিবাদী উদারপন্থী ইরাকী স্কুল এবং রক্ষণশীল সুন্নাপন্থী হেজাজী স্কুলের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কুরআন ও আইনের অন্যান্য উৎসের তুল্যমানে সুন্নার অবস্থান কি? এই বিতর্কে কেন্দ্রবিন্দু ছিল কুরআন ও আইনের অন্যান্য উৎসের তুল্যমান সুন্নার অবস্থান কি? এই বিতর্কে ইমাম শাফেয়ী ও (৭৬৭-৮২০ খৃ:) জড়িয়ে পড়েন। তিনি ঐত্যিহ্যবাদী ও প্রগতিবাদীদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে গতিশীল অবস্থান গ্রহণ না করে মধ্যবর্তী আর এক অবস্থান গ্রহণ করেন ফলে শাফী মাজহাব গড়ে ওঠে। আবার আহমদ ইবন হাম্বল (৭৮০-৮৫৫ খৃ:) শাফী, মালেকীদের নমনীয় মনোভাবের পরিবর্তে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। এরূপ অবস্থায় হাম্বলী মজহাব গড়ে ওঠে। সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে উক্ত চারজন বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গির যে ভিন্নতা দেখা দেয় শিক্ষাক্ষেত্রেও উক্ত মজহাবগুলোর স্ব স্ব নীতির প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষা গ্রহণের বিষয়, শিক্ষাপদ্ধতি কি হওয়া উচিত সে বিষয়ে উক্ত মাজহাবের স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে। বাগদাদ, মসূল, দামাস্কাস, হালাব, মিসর এবং নিশাপুরে পৃথক পৃথক মজহাবগুলোর পৃথক পৃথক মাদরাসা বা বিদ্যাপীঠ ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে দামাস্কাসে ৩৩টি হানাফী, ৩১টি শাফী, ৯টি হাম্বলী, ১টি মালেকী মাদরাসা ছিল। আর ৬টি শাফী ও হানাফী উভয় মাদরাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ‘ Encyclopaedia of Islam, Masjid, P-381’. হানাফী বিদ্যাপীঠে পঠিত বিষয়সমূহের মধ্যে ছিল আবশ্যিক  (Compulsory) ও ঐচ্ছিক (Optional) বিষয়। প্রাপ্তবয়স্ক সকল মুসলিমের জন্য নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাতের বিধানাবলী, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জ্ঞান, হালাল-হারামের জ্ঞান, আচার-ব্যবহার, বিবাহ ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয় জানা আবশ্যকীয় ছিল। অন্যদিকে ঐচ্ছিক বিষয় ছিল নীতিবিদ্যা, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি।
শাফী বিদ্যাপীঠে পঠিত বিষয় বিভক্ত হয়েছিল ধর্মীয় (Religious) দর্শবিমুখ (Non-recligious) এ দু’প্রধান বিষয়ে। ধর্মবিমুখ শিক্ষার মধ্যে কিছু ছিল হারাম (Forbidden)) কিছু মাকরূহ (Disliked)আর কিছু মুবাহ (Permissible)। তার মধ্যে হারাম হলোÑ জাদুবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন এবং যা মনে সন্দেহের উদ্রেক করে তেমন বিষয়। আর ধর্মীয় (Religious) শিক্ষা তিন ভাগে বিভক্ত ছিল (১) আবশ্যকীয় (Obligatory) (২) ঐচ্ছিক  (Optional) ও ৩) অতিরিক্ত (Voluntary) আবশ্যকীয় বিষয়ের মধ্যে ছিলÑ ওযুর নিয়মাবলী, নামাযের নিয়ম-কানুন। এছাড়া পিতা-মাতার প্রতি সন্তানকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দান করতে বলা হয়, যা আবশ্যকীয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত যেমনÑ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা, সংযমী হবার শিক্ষা এবং অনৈতিক কার্যকলাপ, চুরি, মদ্যপান, মিথ্যা বলা, পরনিন্দা ইত্যাদি খারাপ কাজ বিরত রাখতে বাধ্য করা। কুরআন শিক্ষা, ফিকহ, আরবী ভাষা ও গ্রামার ইত্যাদি বিষয় ও আবশ্যকীয় বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঐচ্ছিক (Optional) বিষয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল মুসলিম ব্যবহার শাস্ত্র, আরবী ভাষা, গ্রামার এবং হাদীস বিশারদদের জীবনী, মুসলিম মুজতাহিদদের বুদ্ধিবৃত্তিক মতামত (ইজমা) ইত্যাদি। এছাড়া চিকিৎসাবিদ্যা ও গণিতশাস্ত্র যা মানবকল্যাণে প্রয়োজনীয়। আবার শিয়া বিদ্যাপীঠে তাদের রাজনৈতিক দর্শনের অগ্রাধিকার দেয়া হলেও বিজ্ঞান এবং দর্শন নির্ভর শিক্ষা তাদের পাঠ্যবস্তু ছিল।
কাজেই দেখা যায়, মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে শিয়া, সুন্নী সকল সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব চিন্তা চেতনার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে একটি মানবকল্যাণময় শিক্ষা ব্যবস্থার উপহার দিয়েছিল। তবে হানাফী মজহাব অন্যান্য মজহাব থেকে উদারপন্থী ও প্রগতিশীল হওয়ায় পূর্বাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চলীয় মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে হানাফী মতাদর্শে গড়ে ওঠা বিদ্যাপীঠগুলো এ অঞ্চলে শিক্ষাদীক্ষায় বেশ অবদান রাখে। তাই এ অঞ্চলেই অধিকাংশ মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবির্ভাব হয়। এ ক্ষেত্রে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যায় ৮৩০ খৃ: বাগদাদে খলিফা আল মামুন কর্তৃক বায়তুল হিকমাহ (বিজ্ঞানভবন) প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে। উচ্চতর মানবিক বুদ্ধিবৃত্তিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষা গবেষণাকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়। অনুবাদকেন্দ্র ছাড়াও এ প্রতিষ্ঠান শিক্ষা সংক্রান্ত গবেষণাকেন্দ্র ও সাধারণ পাঠাগার হিসেবে কাজ করত। এর সঙ্গে একটি মানমন্দিরও ছিল। বায়তুল হিকমাহ মধ্য ও প্যারিস, ফ্রান্স, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের অনেক পূর্বে আলোক বিতরণ করেছিল। বাগদাদ এ সময় ইউরোপ, এশিয়ার সকল জ্ঞান পিপাসুদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল। এছাড়া বসরা, কুফায় গড়ে ওঠে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাচ্য সিরাজ, মারগা, ইস্পাহান, গজনি, মার্ভ, নিশাপুর, রায়, বুখারা, সমরককন্দসহ অনেক নগর বন্দরে গড়ে ওঠে বিজ্ঞান মানমন্দির। ‘মূসা আনসারী, প্রগুক্ত, পৃ: ২৬০।’ প্রতিটি হাসপাতালে চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হতো। বিজ্ঞান মানমন্দিরে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, যন্ত্র প্রকৌশলীবিদ্যা শিক্ষা দেয়া হতো। এছাড়া ১০৬৫-৭ সালে নিযামুলমূলক তুসীর প্রতিষ্ঠিত নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মুসলিম বিশ্বের বহুদিনের আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ‘Hitti, OP. Cit. P-410’ এতে একটি পাঠ্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। এ শিক্ষাক্রমে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় দর্শনের প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। আরবী ভাষা, ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, সাহিত্য, যুক্তিবিদ্যা, অংকশাস্ত্র, স্কলাসটিক দর্শন পাঠদানের মধ্যদিয়ে এর মানবিক শাখা গড়ে ওঠে। তফসির, হাদীস, ফিকহ শাস্ত্র, পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা বিভাগ হিসেবে গড়ে ওঠে। মধ্যযুগে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংগঠনিক কাঠামো, পাঠ্যক্রম নিজামিয়ার আদলে গড়ে ওঠে। ‘Hitti, OP, Cit, P-416’ মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা মধ্যযুগে স্পেনেও উন্নতির চরম শিখরে পদার্পণ করেছিল। কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, সেভিল প্রভৃতি শহরে অসংখ্য বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠেছিল। পশ্চিম ইউরোপে টলেডো আরব জ্ঞানবিজ্ঞানের বড় কেন্দ্র হিসেবে বহুদিন ধরে টিকেছিল। বস্তুত বলা চলে টলেডো ছিল প্রাচ্য বিদ্যাপীঠ (First school of oriental) ÔHitti, OP, Cit, P-606-7. মুসলিমবিশ্বের প্রতিটি জনপদে এরূপ সমৃদ্ধ যুগোপযোগী মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছায়াতলে জন্ম নেয় হাজার হাজার মুসলিম জ্ঞানী-গুণী, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী। মুসলিম এ সকল মনীষীরা প্রাচীন জ্ঞানবিজ্ঞানকে উদ্ধার করে যেমন অনুবাদের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য সংরক্ষণ করেছিলেন তেমন জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যেমনÑ রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল ও সমুদ্রবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, ইতিহাসশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও প্রকৌশল স্থাপত্যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে, কৃষিবিজ্ঞানে, দর্শন, আইনশাস্ত্রে প্রভৃতি ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রেখে যান। যা স্পেনের মাধ্যমে মূলত ইউরোপে প্রবেশ করে। যার ফলে তৎকালীন ইউরোপের উদীয়মান বুদ্ধিজীবীরা মুসলিম জ্ঞানবিজ্ঞান, শিক্ষালাভ করে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত সেমিনারি বা একাডেমি বা কলেজে এগুলো একটি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করায় অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, প্যারিস, সারবোন, বোলাঙ, সালের্নো প্রভৃতি বিখ্যাত বিদ্যানিকেতন প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে কেবল মুসলিম বিজ্ঞান দর্শন পঠন-পাঠনই হতো না বরং আরবী ভাষা থেকে তা অনুবাদের মাধ্যমে সকলের পড়ার উপযোগী করে তোলা হতো। আর একাদশ শতকে চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যখন ল্যাটিন ইউরোপে প্রগতিশীলতার বিকাশ উন্মুখ হয় তখন ইউরোপীয় সেমিনারিতে স্কলাসটিক দর্শনের প্রভাবে ডায়ালেকটিক বাক্যে সর্বস্ব কূটতর্কের প্রভাব বিদ্যমান থাকলেও যেহেতু এতে রহস্যবাদ জড়িত ছিল না, তাই মুসলিম বিজ্ঞান দর্শনের বহুল চর্চার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান মনস্কতার উন্মেষ ঘটে। যেমন রোজার বেকনের প্রয়োগবাদ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিচার ধারার ওপর ইবনে হায়সামসহ অন্যান্য মুসলিম বিজ্ঞানীদের প্রভাব ছিল খুবই লক্ষণীয়। ‘S.M. Sharif. ed. History. ed. History of Muslim Philosophy, Delhi, 1984, P-1370’. বস্তুত একাদশ হতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে প্রয়োগবাদ, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটে, ফলে ইতালীয় রেনেসাঁস এবং সতের শতকে নয়া বিজ্ঞানের পটভূমি রচিত হয়। ‘Hitti, Oo. Cit, P-490’
তাই বলা যায়, মুসলমানদের ইতিহাসের যেসব দিক নিয়ে তাদের গর্ব করার মতো কিছু আছে তার মধ্যে অন্যতম তাদের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস। শিক্ষার যথেষ্ট সংজ্ঞা যদি Harmonious development of soul body and mind হয় তাহলে মধ্যযুগের মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থাই ছিল প্রকৃত শিক্ষার স্বরূপ। বর্তমান কালের শিক্ষাব্যবস্থায় মানবতাবিরোধী অনৈতিক কার্যকলাপকেই যখন শিক্ষা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয় সেদিক দিয়ে মধ্যযুগের মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক শিক্ষার মান থেকেও অনেকাংশে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল এবং এ শিক্ষাই যুগ যুগ ধরে প্রতিনিধিত্ব করে বিশ্বসভ্যতায় বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট